শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ
شرح معاني الآثار المختلفة المروية عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في الأحكام
ইমাম তাহাবী ও ত্বহাবী শরীফঃ
ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (রহ:)-এর জীবনী:
ইমাম আবূ জা’ফর আহমদ তাহাবী (রহ:) (জন্ম ২৩৮ হিজরী মৃত্যু ৩৩১ হিজরী) ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের একজন হাদীস বিশারদ, ফক্বীহ, আইন বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিত।
মিসরের ‘তাহা’ নামক জনপদের অধিবাসী হিসেবে তিনি ‘তাহাবী’ নামে পরিচিত। তাঁর সংকলিত হাদীস এবং হাদীসের বিধানাবলী ও হাদীস বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘মা‘আনিল আছার’ তাহাবী শরীফ নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইসলামী সাম্রাজ্য যখন বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পন্ডিতগণ রাজ্য বিস্তারের অভিযান থেকে বিভিন্ন জ্ঞানের সাধনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
পরিচিতি:
তাঁর নাম আহমদ, পিতার নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু জা’ফর, দাদার নাম সালামা, নিসবতী নাম তাহাবী, আযদী, মিসরী, হাজরী, হানাফী।
বংশ পরিচিতি ঃ
তাহাবী শরীফে তাঁর বংশ পরিচয় নিম্নবর্ণিত পন্থায় উল্লেখ করা হয়েছে-
امام حافظ ابو جعفر احمد بن محمد بن سلامة بن عبد الملك بن سلمة بن سلسم بن سليمان من خباب الازدى الحجرى المصرى الطحاوى والحنفى-
ইমাম তাহাবী (রহ:) এর পূর্ণ নাম ইমাম হাফিয আবূ জা’ফর আহমদ ইবন মুহাম্মদ ইবন সালামা ইবন আবদুল মালিক ইবন সুলাইম ইবন খাব্বাব আযদী হাজারী মিসরী আত-তাহাবী আল-হানাফী।
জন্ম বৃত্তান্ত ঃ
তিনি বর্তমান মিসরের ‘তাহা’ নামক প্রাচীন গ্রামে ২৩৮ হিজরীর ১২/১০ রবিউল আওয়াল রবিবার শুভ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইয়ামানের সুপ্রসিদ্ধ আয্দ এবং এর শাখা হাজার গোত্রভুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে মিসর বিজয়ের পর তারা মিসরে এসে বসবাস শুরুকরেন। যেহেতু তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইয়ামানের আযদ ও হাজার গোত্রের অধিবাসী ছিলেন, এজন্য ইমাম তাহাবী (রহ:) কে আযদী ও হাজারী বলা হয়। আর যেহেতু মিসরের ‘তাহা’ নামক প্রাচীন পল্লীতে তাঁর জন্ম এজন্য তাঁকে মিসরী ও তাহাবী বলা হয়।
শৈশব ঃ
তাঁর শৈশবকাল ছিল অত্যন্ত পূতঃপবিত্র ও নির্মল। তিনি কখনো পাপাচার বা গর্হিত কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। শৈশবকাল হতেই শিক্ষার প্রতি তাঁর অসাধারণ অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়।
ইলম অর্জনে ইমাম তাহাবী ঃ
তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় তাঁর মামা আবু ইবরাহীম ইসমাঈল ইবনে ইয়াহিয়া মুযানী (রহ:) এর নিকট। মুযানী শাফেয়ী মাযহাবের একজন প্রখ্যাত আলেম ছিলেন। আল্লামামুযানী (রহ:) তখন মিশরে অবস্থান করতেন। ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (রহ:) জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করার মানসে স্বীয় আবাসস্থল থেকে মিশরে আসেন।
তিনি জ্ঞান আহরণের মিমিত্তে অনেক জায়গা সফর করেন। যেখানেই কোন জ্ঞান তাপসের সন্ধান পেতেন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করতেন। ২৬৮ হিজরিতে তিনি সিরিয়া ভ্রমণ করেন। তা ছাড়া বায়তুল মুকাদ্দাস, আসকালান ইত্যাদি স্থানে মনীষীদের থেকে হাদীস শ্রবণ করেন। দামেশকের আবু আযেম আব্দুল হামীদ থেকে ইলমে ফিকহের জ্ঞান লাভ করেন। বিভিন্ন দেশের মনীষীদের থেকে জ্ঞানার্জন করে ২৬৯ হিজরিতে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
শিক্ষকমন্ডলী ঃ
তিনি অসংখ্য উস্তাদ থেকে ফিক্হ, তাফসীর, হাদীস, আরবী সাহিত্য, নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন।
তাঁর প্রসিদ্ধ উস্তাদগণ হলেন-
০১। ইবরাহীম ইবনে আবু দাউদ বারলাছী,
০২। ইবরাহীম ইবনে যানকাদ খাওলানী,
০৩। ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ,
০৪। ইবরাহীম ইবনে মারযুক বসরী,
০৫। আহমদ ইবনে কাসেম কূফী,
০৬। আহমদ ইবনে দাউদ ছাদুছী,
০৭। আহমদ ইবনে সাহল রাযী,
০৮। আহমদ ইবনে আছাম মুযানী,
০৯। আহমদ ইবনে মাসউদ মাকদাসী,
১০। আহমদ ইবনে সাঈদ ফাহরী,
১১। আবু বশির আহমদ দুলাবী,
১২। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম,
১৩। ইসহাক ইবনে হাসান,
১৪। ইসমাঈল ইবনে ইয়াহিয়া মুযানী,
১৫। বাহার ইবনে নসর খাওলানী,
১৬। বাকার ইবনে কুতাইবা,
১৭। মুহাম্মদ ইবনে সালামা তাহাবী প্রমুখ।
ইমাম তাহাবীর সহচর ও ছাত্রবৃন্দ ঃ
অগণিত জ্ঞান পিপাসু তাঁর নিকট হতে জ্ঞান আহরণে নিজেদেরকে ধন্য করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রগণ হলেন-
০১। আবু উসমান আহমদ ইবনে ইবরাহীম,
০২। আহমদ ইবনে আবদুল ওয়ারেস যুজাজ,
০৩। আহমদ ইবনে মুহাম্মদ দামেগানী,
০৪। আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে কাসেম,
০৫। সুয়ালমান ইবনে আহমদ তিবরানী,
০৬। আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে হাদীদ,
০৭। আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক জাওহারী,
০৮। আবুল কাসেম উবায়দুল্লাহ ইবনে আলী দাউদী প্রমুখ।
হাদীস শিক্ষায় ইমাম তাহাবী (রহ:) এর সফর ঃ
ইমাম তাহাবী (রহ:) তৎকালের মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদীস কেন্দ্রসমূহ সফর করে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেছেন। মিসর, ইয়ামান, হিজায, শাম, খোরাসান, কূফা, বসরা, রায় ও ইরাকে হাদীস সংগ্রহের জন্য বছরের পর বছর পরিভ্রমণ করেছেন।
তাহাবী শরীফ রচনার কারণ ঃ
ইমাম তাহাবী (রহ:) شرح معانى الاثار তাঁর কিতাবের ভূমিকা লিখেন-
قال ابو جعفر الطحاوى (رح) سألنى بعض اصحابنا من اهل العلم ان اضع له كتابا اذكر فيه الاثار المأثورة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فى الاحكام التى يتوهم اهل الالحاد والضعفة من اهل الاسلام ان بعضها ينقض بعضا لقلة علمهم بنا سخها من منسوخها وما يجب به العمل منها لها يشهدله من الكتاب الناطق والسنة المجتمع عليها واجعل لذلك ابوابا اذكر فى كل كتاب منها ما فيه من الناسخ والمنسوخ وبأويل العلماء واحتجاج بعضهم على بعض واقامة الحجة لمن صح عندى قوله منهم بما يصح به مثله من كتاب او سنة او اجماع او تواتر من اقاويل الحابة او تابعيهم- وانى نظرت فى ذلك وبحثت عنه بحثا شديدا- فاستخرجت منه ابوابا على النحو الذى سأل وجعلت ذلك كتبا- ذكرت فى كل كتاب منها جنسا من تلك الاجناس-
অর্থ: ইমাম আবু জা’ফর আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন সালামা আল-আযদী-আত তাহাবী (রহ:) বলেনঃ
আমার এক জ্ঞান পিপাসু সুহৃদ বন্ধু আমার নিকট এ মর্মে অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন যে, আমি যেন তাঁর জন্য একটি বিশেষ গ্রন্থ রচনার ব্রতী হই, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সূত্র পরস্পরায় বর্ণিত আহকাম (বিধানাবলী) সংশ্লিষ্ট বাণীসমূহ সন্নিবেশিত করি। এসব বিধান নিয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিকেরা ও দুর্বলমতি মুসলমানেরা (হাদীস অস্বীকাকারী ভ্রান্ত দল) ‘নাসিখ’ (রহিতকারী) ও ‘মানসূখ’ (রহিত) সম্পর্কে তাদের স্বল্পজ্ঞান হেতু এবং প্রজ্ঞাময় কুরআন ও ঐকমত্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহর সাক্ষ্য ও সমর্থনের ভিক্ততে যে সব বিধানের উপর আমল করা আবশ্যক; কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের স্বল্পজ্ঞান হেতু এ মর্মে অমূলক ধারণা পেষণ করে যে, আল্লাহর কতক বিধান অপর কতক বিধানের সাথে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক।
তিনি আরো অনুরোধ করলেন, আমি যেন গ্রন্থটিকে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বিভক্ত করি। গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়ে ‘নাসিখ’ ‘মানসূখ’, বিশেষজ্ঞ আলিম-মনীষীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহ যেন সন্নিবেশিত থাকে।
আর বিশেষজ্ঞ আলিম-মনীষীদের যে সব মত আমার নিকট বিশুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হবে, সেগুলোকে কুরআন বা সুন্নাহ অথবা ইজমা কিংবা সাহাবা ও তাবেঈগণের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক অভিমতগুলো প্রমাণাদি দ্বারা যেভাবে অনুরূপ বিধান বিশুদ্ধরূপে প্রমাণ করা হয় সেভাবে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হই।
আমি বিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে নিতান্ত নিবিড়ভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন সেভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করে তা প্রমাণিত করতে চেষ্টা করেছি। আমি গ্রন্থটিকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিক্ত করে প্রতিটি অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহের অবতারণা করেছি।
অতএব আমি সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাহারাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ দ্বারা কিতাবের সূচনা করেছি।
হাদীসের ময়দানে ইমাম তাহাবী (রহ:) এর পদমর্যাদা ও অবস্থান:
হাদীসের জগতে এক স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম তাহাবী রহঃ।
হাদীসের ময়দানে যিনি ছিলেন নক্ষত্র তুল্য এবং হাদীস বিশারদদের মারজি' তথা যার নিকট হাদীসের বিষয়ে তার যুগের হাদীসবিশারদগন পর্যন্ত শরনাপন্ন হতেন।
ইমাম তাহাবী (রহ:) একাধারে হাফেযে হাদীস, ফিক্হ শাস্ত্রে পন্ডিত এবং উসূলে ফিকহে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন উক্তি করেছেন। যেমন-
০১। সাময়ানী বলেছেন-
كان اماما ثقة عاقلا لم يخلف مثله
০২। আল্লামাজালাল উদ্দিন সুয়ূতী حفاظ الحديث গ্রন্থে লিখেন-
كان مرجعا لعلم الحديث ودعاء لعلوم الدين وكان ثقة ثبتا فقيها لم يخلف بعده مثله انتهت اليه رياسة الحنفية بمصر- برع فى الفقه والحديث وصنف النصانيف البديعة والكتب المفيدة
০৩। আল্লামাযাহাবী গ্রন্থে تذكرة الحفاظ বলেন-
كان رحمه الله ثقة ثبتا فقيها عالما لم يخلف مثله
০৪। আবু ইসহাক সিরাজী الطبقات গ্রন্থে বলেন-
انتهت الى ابى جعفر رياسة اصحاب ابى حنيفة (رح) بمصر
০৫। আল্লামাআইনী বলেন,
هو اعلم الناس بمذهب ابى حنيفة
০৬ ও ০৭। শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী গুফিরা লাহু تحقيق الآيات البينات في عدم سماع الأموات
কিতাবে ইমাম তাহাবী সম্পর্কে বলেন,
هو أحمد بن محمد بن سلامة أبو جعفر الطحاوي المصري من كبار أئمة الحنفية الجامعين بين الفقه والحديث وله الباع الطويل في حفظ متونه وأسانيده يجد عنده الباحث من الحديث ما لا يجد عند غيره من الحفاظ على تساهل في الاحتجاج به وتعصب لمذهبه كما شهد بهذا الثاني أبو الحسنات اللكنوي في " الفوائد البهية " (ص 33) وبالذي قبله شيخ الإسلام ابن تيمية في " منهاج السنة " وغيره توفي سنة (321)
এখানে আগে ইমাম তাহাবীর পরিচয় দিয়ে আলবানী সাহেব বলেন, হাদীসের সনদ এবং মতনের উপর পূর্ণ দক্ষতা ছিল ইমাম তাহাবীর এমনকি হাদীস আহরণকারী পিপাসু তালিবানে ইলম তাহাবীর মতো হাফিযুল হাদীসের কাছে এমন প্রচুর হাদীস শিখত যা উনি ছাড়া অন্যান্য হাদীস বিশারদগনের নিকট তারা পেতনা।
এর সত্যতা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার রহঃ নিম্নের কথাতেও মিলে, উনি তার منهاج السنة النبوية কিতাবে পর্যালোচনা মূলক কথার পর বলেন,
وإن كان كثير الحديث فقيها عالما
অর্থাৎ তাহাবী রহঃ কাছীরুল হাদীস তথা হাদীসের ময়দানে স্বীয় সমসাময়িক মুহাদ্দিসদের থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলেন এবং সাথে সাথে একজন স্বীকৃত ফকীহ আলেম ছিলেন। (মিনহাজুস সুন্নাহ)
সমাজের একশ্রেনীর ভাইয়েরা হাদীসের এই মহান ইমাম সম্পর্কে কটুক্তি করে থাকেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেবরা তো ওনাদের কাছে অবশ্যই সম্মানিত এবং সমালোচনার উর্ধ্বব্যক্তিত্ব, ইনারা পর্যন্ত ইমাম তাহাবী রহঃ এর হাদীস শাস্ত্রের পান্ডিত্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন নি আর সন্দেহ পোষণ তো দূরের কথা উপরন্তু তারা ইমাম তাহাবী রহঃ এর ভূয়সি প্রশংসা করেছেন।
আর আমি আপনি একজন সাধারণ থেকে অতিসাধারণ ব্যক্তি যে হাদীস শাস্ত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞ,ইলমের সুবিশাল ময়দানে যার কোনোই পদচারণা নেই ইমাম তাহাবী রহঃ সম্পর্কে কটুক্তি করে তার অবজ্ঞার প্রদর্শন করে নিজেরাই গুনাহগার হচ্ছি।
আল্লাহ তাআলা মাফ করেন।।
বুঝার তৌফিক দিন সমাজের সেই শ্রেনীর ভাইদেরও যারা ভূল বুঝে ইমাম তাহাবী রহঃ ও অন্যান্য বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে অযাচিত ভাষার প্রয়োগ করে থাকে।
ইমাম তাহাবী (রহ:)এর স্মৃতি শক্তি ঃ
ইমাম তাহাবী (রহ:) অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তীক্ষ্ণ মেধা শক্তি বলেই তিনি ফিক্হ শাস্ত্রের পন্ডিত হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
ইমাম তাহাবী (রহ:) এর ব্যক্তিত্ব ঃ
ইমাম তাহাবী (রহ:) মহা মর্যাদা ও মহা সম্মানের অধিকারী ছিলেন। নির্ভরযোগ্যতা, আমানতদারী, মর্যাদার পূর্ণতা, হাদীসের দক্ষতা, নাসেখ ও মানসুখ হাদীসের পার্থক্য করলেন দক্ষতার ব্যাপারে ইজমা হয়ে গিয়েছে। তাঁর পরে কেউ তার স্থান পূরণ করতে পারেনি।
মাসলামা ইবনে কামে কুরতুবী আস সিলাহ নামক গ্রন্থে বলেন, ইমাম তাহাবী (রহ:) নির্ভরশীল মহা মর্যাদার অধিকারী, ফিক্হবিদ এবং আলেমদের মতভেদ পূর্ণ মাসয়ালায় অন্তদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন।
ইবনে জুযী ‘মুনতাযিম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, ইমাম তাহাবী (রহ:) নির্ভরশীল, সুদৃঢ়, সুবিজ্ঞ ও প্রখ্যাত ফিক্হবিশারদ ছিলেন।
আল্লামা যাহাবী তদীয় গ্রন্থে বলেছেন, তিনি ফিক্হবিদ, মুহাদ্দিস, হাফিয, বিশিষ্ট ইমাম, নির্ভরশীল, ধী শক্তি সম্পন্ন ও দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
ইমাম তাহাবী (রহ:)এর রচনা সম্ভার ঃ
ইমাম তাহাবী (রহ:) অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকটি গ্রন্থ হলো-
(০১)
العقيدة الطحاوية: والتي قال عنها السبكي: (جمهور المذاهب الأربعة على الحق يقرؤون عقيدة الطحاوي التي تلقاها العلماء سلفاً وخلفاً بالقبول).
(০২) شرح معانى الاثار-
(০৩) اختلاف العلماء-
(০৪) المختصر فى الفقة-
(০৫) شرح الجامع الكبير للشيباني في الفروع.
(০৬) شرح الجامع الصغير-
(০৭) كتاب الشروط الكبير-
(১১) عقود المرجان في مناقب أبي حنيفة النعمان -
(১২) قسمة الفيء والغنائم -
(১৩) نقد المدلسين على الكرابيسي-
(১৪) الفرائض
(১৫) المختصر الكبير
(১৬) المختصر الصغير-
(১৭) شرح مشكل الآثار
(১৮) احكام القران-
(১৯) المحاضرات والسجلات.
(২০) كتاب التاريخ
(২১) سنن الشافعى-
(২২) اختلاف الروايات علي مذهب الكوفيي-
(২৩) شرح المغنى-
(২৪) - حكم أراضي مكة المكرمة
(২৫) النوادر الفقهية-
(২৬) - الشروط الصغير
(২৭) كتاب التسوية بين حدثنا وأخبرنا
ইমাম তাহাবী (রহ:) এর ওফাত ঃ
ইবনে খাল্লেকান وفيات الاعيان গ্রন্থে ইমাম তাহাবী (রহ:)-এর ওফাত প্রসঙ্গে বলেন যে, যুগ শ্রেষ্ঠ ফিক্হশাস্ত্রবিদ, আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্ঞান তাপস আল্লামাআবু জা’ফর তাহাবী (রহ:) ৩২১ হিজরি সন মোতাবেক ৯৪৩ খিস্টাবেদ ৯২ বছর বয়সে যিলকদ মাসের চাঁদনী রজনী বৃহস্পতিবার মিসরে ইন্তিকাল করেন।
এ ব্যাপারে আল্লামা সামআনী (রহ:), আল্লামাইব্ন কাসীর (রহ:), ইব্ন খালকান, আল্লামাইব্ন হাজার আসকালানী (রহ:), আল্লামাসুয়ূতী (রহ:) ও আল্লামা হামুবী (রহ:) প্রমুখ ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
তদীয় গ্রন্থ শরহু মায়ানিল আছারের বৈশিষ্ট্যাবলি ঃ
যুগশ্রেষ্ঠ ফিক্ইবদ ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (রহ:) কর্তৃক রচিত জগতবিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘শারহু মা’য়ানিল আছার’ এর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
০১। এ গ্রন্থে হাদীসের আলোকে ফিক্হী মাসয়ালার বিবরণ পেশ করা হয়েছে।
০২। এ গ্রন্থে এরূপ অনেক হাদীস রয়েছে যা অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
০৩। এ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহের সনদ শক্তিশালী ও জোরালো। দুর্বল সনদের কোন হাদীস এ গ্রন্থে নেই।
০৪। এ গ্রন্থের মূল ভাষ্যে অনেক ফায়দা রয়েছে। যেমন- এ গ্রন্থটিতে মাসয়ালা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা অন্যান্য কিতাবে সংক্ষেপ আকারে বর্ণনা করা হয়েছে।
০৫। এ গ্রন্থে সাহাবী, তাবেয়ী ও অন্যান্য ইমামদের এমন অসংখ্য বাণী রয়েছে যা সমসাময়িক অন্যান্য ইমামদের গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
০৬। এ গ্রন্থে গ্রন্থকার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের অসংখ্য উক্তি পেশ করেছেন।
০৭। গ্রন্থকার এ কিতাবে ফিকহী মাসয়ালাসমূহ বর্ণনা করার সাথে সাথে হাদীসের আলোকে পক্ষের ও বিপক্ষের অভিমত পেশ করেছেন। যা একটি অতুলনীয় গ্রন্থ।
০৮। গ্রন্থকার এ গ্রন্থকে ফিক্হ শাস্ত্রের গ্রন্থাবলি অনুযায়ী বিন্যস্ত করেছেন। তারপর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইমামদের মতবেধসহ তাদের পক্ষের হাদীসমূহ বর্ণনা করেছে। অতঃপর হাদীসের আলোকে প্রতিপক্ষের উত্তর দিয়েছেন। সর্বশেষে স্বীয় সুচিন্তিত ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত উপস্থাপন করেছেন, যা সর্বজন সবীকৃত ও গৃহীত। এ ধরনের কিতাব সত্যিই বিরল।
০৯। গ্রন্থকার এ গ্রন্থে হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য দিতে গিয়ে আহনাফের দলিলসমূহ বর্ণনা করার সাথে সাথে বিরুদ্ধবাদীদের দলিলসমূহও বর্ণনা করেছেন। তাই আল্লামা আমীর আতকানী বলেছেন যে, যদি কেউ শারহু মা’য়ানিল আচারের প্রতি গভীর চিন্তা ভাবনা করে, তাহলে তার আমাদের হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবের জ্ঞানও অর্জিত হবে।
১০। এ গ্রন্থে একই সনদের অসংখ্য হাদীষ আনা হয়েছে। যা অপর কোন গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় না।
১১। এ গ্রন্থে একই সনদের অসংখ্য হাদীস, ফিক্হবিদদের উক্তি এবং ইমামদের جرح ও تعديل এর বর্ণনা করা হয়েছে।
শারহু মা’য়ানিল আছার গ্রন্থের দলিল বর্ণনা পদ্ধতি ঃ
ইমাম আবু জাফর আত্-তাহাবী (রহ:)-এর বিখ্যাত شرح معانى الاثار গ্রন্থে দলিল বর্ণনার পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ-
০১। কুরআনুল কারীম থেকে দলিল ঃ ইমাম তাহাবী (রহ:) তাঁর কিতাবে দলিল বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কুরআনুল কারীম থেকে আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কেননা, তাঁর মতে, কুরআনুল কারীম হলো শরীয়তের মূল উৎস।
০২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত থেকে দলিল ঃ কুরআনুল কারীমের দলিল উদ্ধৃতির পরে ইমাম তাহাবী (রহ:) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি হাদীসের সনদ বিশ্লেষণপূর্বক যা সহীহ বলে জেনেছেন একমাত্র তা-ই উল্লেখ করেছেন। কেননা, দূর্বল পরিত্যাজ্য হাদীসের বর্ণনা তিনি এ কিতাবে করেননি। এছাড়াও একই সনদের অসংখ্য হাদীস এ কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
০৩। সাহাবীদের বক্তব্য থেকে দলিল ঃ সাহাবীদের থেকে যে সব উক্তি ইমাম তাহাবী (রহ:)-এর নিকট ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে, সে সব বিষয় দলিল হিসেবে তিনি তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
০৪। সাহাবীদের ঐকমত্য থেকে দলিল ঃ সংশ্লিষ্ট বিষয় সাহাবীদের اجماع তথা ঐকমত্য আলোচনা কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
০৫। তাবেয়ীদের বক্তব্য থেকে দলিল ঃ তাবেয়ীদের বক্তব্য থেকে যাদে বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে সে সব বক্তব্যও দলিল হিসেবে তাঁর কিতাব বর্ণিত হয়েছে।
০৬। পরস্পর দু হাদীসের সমাধান ঃ দলিল বর্ণনায় পরস্পর বিরোধী দুটি হাদীস পাওয়া গেলে তা বিশ্লেষণপূর্বক হাদীসের আলোকেই তন্মধ্যে একটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ:)-এর অভিমতই অগ্রাধিকার পেয়েছে।
০৭। বাস্তবসম্মত যুক্তি পেশ ঃ ইমাম তাহাবী (রহ:) যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে কুরআন ও হাদীসের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন, ফলে প্রদত্ত দলিল আরো সুদৃঢ় ও শক্তিমালী হয়েছে।
০৮। প্রসিদ্ধ ইমামদের বক্তব্য পেশ করণ ঃ
দলিল বর্ণনায় আলোচ্য গ্রন্থে অপরাপর ইমামদের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো মতবিরোধ পূর্ণ বক্তব্য হলে তাঁর দলিল উল্লেখপূর্বক তা খণ্ডন করে নিজের দলিলকে শক্তিশালী করেছেন। এজন্যই আল্লামা আতকানী (রহ:) বলেন, যদি কেউ شرح معانى الاثار এর প্রতি গভীর চিন্তাভাবনা করে তবে তার হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবের জ্ঞানও অর্জিত হবে।
রচয়িতার রচনা পদ্ধতি:
আল্লামাআবূ জা’ফর তাহাবী (রহ:) কর্তৃক রচিত শারহু মায়ানিল আছার একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি তিনি এক অভিনব পদ্ধতিতে রচনা করেছেন। বিশ্বব্যাপী ফিকহ ও হাদীসের অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে; কিন্তু কোনো গ্রন্থই এর মতো চমৎকার সজ্জিত নয়।
এ গ্রন্থের বর্ণনা পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লামাআস্ সুয়ূতী (রহ:) বলেন
وضعه على نمط منشط لم يظفر به احد من اولى الاخيار-
واودع فيه ما يكشف به قناع فرائد الاخيار-
وسرد فيه الاحايث بالفاظ رائقة تقر بسماعها عيون الاسماع-
وسلك فى سردها مسالك معجبة فائقة تطرب لملاحظتها الطباع-
মুহাদ্দিসগণের নিকট شرح معانى الاثار -এর অবস্থান:
তদীয় গ্রন্থ شرح معانى الاثار ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহের এক অনন্য ও প্রসিদ্ধ কিতাব, যা সকল মুহাদ্দিস ও ফকীরের নিকট নির্ভরযোগ্য ও সমাদৃত। আল্লামাআইনী (রহ:) نخب الافكار গ্রন্থে বলেন-
ইমাম তাহাবী (রহ:)-এর নির্ভরযোগ্যতা, আমানতদারিতা, মর্যাদার পূর্ণতা, হাদীসের দক্ষতা, নাসেখ, মানসুখ ও হাদীসের পার্থক্যকরণের দক্ষতার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে। তারপর কেউ তাঁর স্থান পূরণ করতে পারেন নি। আল্লামাআইনীর এ বক্তব্য থেকে شرح معانى الاثار এর স্তর অনুমেয়।
অতএব উপরিউক্ত বক্তব্যের বিচারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম شرح معانى الاثار কিতাবকে সিহাহ সিত্তার পরে অর্থাৎ তৃতীয় স্তরের হাদীসগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথম স্তরে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক। দ্বিতীয় স্তরে সিহাহ সিত্তার বাকি কিতাবগুলো এবং তৃতীয় স্তরেই এ প্রসিদ্ধ কিতাব।
পরিশেষে কথা এই যে, ইমাম আবু জা’ফর আহমদ বিন মুহাম্মদ আত তাহাবী (রহ:) বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এক কালজয়ী মহাপুরুষ। তার তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি যুগে যুগে জ্ঞান পিপাসুর জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করতে থাকবে। বিশেষ করে শরহু মাআ'নিল আছার গ্রন্থের জন্য পুরো মুসলিম উম্মাহ তার কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে।